তন্ময় দত্ত — নিজের পাড়া-প্রতিবেশীর চোখে একজন আদর্শ মানুষ।
তাঁর চেহারায় একরকমের গাম্ভীর্য আছে, আর কথাও বলেন খুবই সংযত ভঙ্গিতে।
তাঁর এলাকায় কেউ তাঁকে নাম ধরে ডাকে না, সবাই তাঁকে সসম্মানে ডাকে,
—“তন্ময়বাবু” বলে।
নিজের গ্রামের হাইস্কুলেই শিক্ষকতা করেন তিনি। শিক্ষকের চাকরি, তাই যথেষ্ট সম্মান পান তিনি।

প্রতিদিন ভোরবেলা বিছানা ছেড়ে উঠেই শাড়ি-ঢাকা পা ফেলতে ফেলতে স্ত্রী মধুমিতা ব্যস্ত হয়ে পরে—চা-টিফিন তৈরি, শাশুড়ির ওষুধ দেওয়া, ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর কাজে—সব কাজ যে একা হাতেই সামলাতে হয় তাঁকে।
তন্ময় সেসময়টা চায়ের কাপ হাতে সংবাদপত্র নিয়ে বসে থাকে, মাঝে মাঝে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে শুধু মনে মনে ভাবে—
"এত শান্ত, এত সাদাসিধে মেয়ে, অথচ আমার মনটা কেন যে ওকে নিয়ে অস্থির থাকে ?"

তাঁর স্ত্রী মধুমিতা দেখতে বিশেষ সুন্দরী নয়, তবে সে ভীষণই স্নেহময়ী ও খুবই দায়িত্ববান।
এতো কিছুর পরেও তন্ময়ের মনে মাঝে মাঝেই এক অচেনা শুন্যতা কাজ করে—যেন কিছু একটা তাঁর জীবনে অনুপস্থিত রয়েছে।
---

কয়েক মাস আগের কথা।
ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে তন্ময় হঠাৎ খুঁজে পেল একটি পুরোনো কিন্তু বেশ পরিচিত নাম—কাঞ্চনা সেন।
প্রোফাইলের ছবিটা দেখেই তন্ময়ের হৃদয়টা একটা মোচড় দিয়ে উঠলো, আরে এতো কলেজ জীবনের সেই কাঞ্চনা, যাকে একসময় ভীষণ পছন্দ করত সে।
কিন্তু বাড়ির চাপে, পারিবারিক অমতের কারণে সে বিয়ে করে ফেলেছিল অন্য কাউকে।
তারপর মুখ বুজে ঢুকে গিয়েছিলো সংসারীক জীবনে ।

আজ ফেসবুকের কল্যানে,দশ বছর পর আবার সেই কাঞ্চনার নাম, ছবি, হাসি—সবই ফিরে এল তাঁর চোখের সামনে।
তন্ময় প্রথমে ইতস্তত করেছিল, তারপর সাহস করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে একটি মেসেজ পাঠাল—
" চিনতে পেরেছিস?"

একটু পরেই অপর প্রান্ত থেকে উত্তর এল—
"হ্যাঁ, তুই তন্ময়? কতদিন পর! কেমন আছিস?"

সেই মুহূর্তেই তন্ময়ের হৃদয়টা আবার নেচে উঠেছিল।
এটা যেন হঠাৎ একঘেঁয়ে জীবনে আবার পুরোনো বসন্তের হাওয়া এসে ছুঁয়ে যাওয়া।
---

এরপর দিন যত গড়াল, তাদের আলাপ তত ঘনিষ্ঠ হল।
প্রথমে কেবল অতীতের গল্প হতো—কলেজের বারান্দা, ক্যান্টিনের চা, বন্ধুবান্ধবদের দুষ্টুমি ইত্যাদি।
তারপর ধীরে ধীরে মনখোলা কথা শুরু হলো।
কাঞ্চনা বলল, তাঁর দাম্পত্য জীবন সুখের নয়। তাঁর স্বামী সদা ব্যস্ত, তাঁর প্রতি উদাসীন। কোনো সন্তান ও নেই তাঁদের।
বড় চাকরি ও মোটা বেতন থাকলেও, জীবনটা আজ ভীষণ একাকিত্বে ঘেরা।

তন্ময়ও বলল নিজের মনের কথা।
—“সংসার আছে, স্ত্রী আছে, ছেলে আছে, তবুও কেমন জানি শূন্য শূন্য লাগে জীবনটা।”

একদিন কাঞ্চনা লিখল—
"আমার মনে হয়, যখনই তোর সঙ্গে কথা বলি তখনই যেন আমি আবার বেঁচে উঠি।"

এই মেসেজ পড়েই তন্ময়ের হৃদয়ের মধ্যে এক অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি হলো।
যেন দীর্ঘদিনের শুকনো খটখটে মাঠে হঠাৎ বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলো।
---

কিছুদিনের মধ্যেই মধুমিতা লক্ষ্য করল—তাঁর স্বামী হঠাতই কেমন যেন বদলে যাচ্ছেন।
আগে যিনি রাতের খাওয়া শেষে ছেলের হোমওয়ার্কের খাতা দেখতেন, কিংবা বই পড়তে পড়তে শুয়ে পড়তেন,
এখন তিনি সারাক্ষণই মোবাইলে ব্যস্ত।
চোখে কেমন যেন এক অন্য উজ্জ্বলতা, মনে কেমন একটা সব সময়ের অস্থিরতা।

একদিন সে মৃদু হেসে তন্ময়কে বলল,
—“ সারাক্ষণ কি এত দেখ ফোনে?”
স্ত্রীর কথায় হকচকিয়ে গিয়ে তন্ময় বলল,
—“ও কিছু না। স্কুলের কাজ।”

মধুমিতা মুখে কিছু বলল না, কিন্তু চোখে এক নিঃশব্দ প্রশ্ন রেখেই চুপ করে গেল।
তন্ময় কিন্তু নিজের মনের থেকে সেই নিঃশব্দ দৃষ্টিপ্রশ্ন এড়াতে পারল না।
---

এক রবিবারের বিকেলে কাঞ্চনা হঠাৎ ফোন করে বললো—
—“তুই কি আমাকে একবারটি দেখতে আসবি না? এতদিন পর, ভাবলাম কাছে বসে দুজনে একটু কথা বলব।”

তন্ময় প্রথমে ইতস্তত করলেও, শেষে রাজি হয়ে গেল।
শহরের এক ক্যাফেতে একান্তে দেখা হল তাঁদের।
কাঞ্চনা একটি লাল শাড়ি পরে এসেছে, চোখে হালকা কাজল দেওয়া, আর ঠোঁটে কলেজ জীবনের সেই পরিচিত লিপস্টিক।
তন্ময় তাকিয়ে রইল তারদিকে—তাঁর মনে হল, দশ বছর আগের সেই মেয়েটিই আজ আবার তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে।

দুজনেই চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ।
তারপর কাঞ্চনাই মৃদুস্বরে বলল,
—“তুই একটুও বদলাসনি।”

এই কথা শুনেই তন্ময়ের বুকের মধ্যে ঝড় উঠল।
---

সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এল সে।
মধুমিতা রান্নাঘরে ব্যস্ত। ছেলেটা পড়ছে।
তন্ময় তাদের দিকে তাকাল, আর হঠাৎই বুকের মধ্যে কেমন একটা অপরাধবোধ জেগে উঠল।

সেই রাতেই মধুমিতা বিছানায় পাশে বসে ধীরে ধীরে বলল,
—“শোনো, আমি কিছুই জানতে চাই না।
সংসার সবসময় প্রেমে বাঁধা থাকে না, আমি জানি।
তাই তোমার মন যদি অন্য কোথাও গিয়ে আনন্দ চায়, আমি তোমাকে আটকাব না।
শুধু মনে রেখো, এই সংসারে আমাদের ছেলেও আছে।
সে যেন কোনোদিন তাঁর বাবাকে না হারায়।”

স্ত্রীর কথায় তন্ময়ের হৃদয়টা মোচড়ে উঠে,চোখ দুটো ভিজে গেলো।
---

পরের রবিবার কাঞ্চনা আবার ডাকল তাঁকে।
তন্ময় জামা গায়ে তৈরি হলো তারকাছে যাবে বলে।
ঠিক সেই সময়ই ছেলে এসে বলল,
—“বাবা, আজকে বের হয়ো না? আমার অঙ্কটা একটু বুঝিয়ে দাও।”

ছেলের কথায় তন্ময়ের মন টা কেঁপে উঠল।
সে অনুভব করলো—আজ যদি সে বেরিয়ে যায়, তবে আর কোনোদিনও তাঁর এই সংসারে ফেরা হবে না।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দ্বিধার পর মোবাইলটা হাতে নিয়ে কাঞ্চনাকে মেসেজ লিখল সে—
"ক্ষমা করিস আমায়। আমি পারলাম না। আমি শুধু এক সাধাসিধে সংসারী মানুষ। একজন বাবা"
---

সেই রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হলো। মধুমিতা নিঃশব্দে বিছানায় এসে স্বামীর পাশে বসে তাঁর হাত ধরে রইল।
মুখে কোনো কথা নেই, কেবল স্বামীকে নীরব সমর্থন।
তন্ময় ধীরে ধীরে মাথা নামিয়ে রাখল স্ত্রীর কোলে।

বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে আসছে।
ভোরের আলো ফুটছে।
তন্ময়ও ততক্ষনে বুঝে উঠেছে—
পরকীয়া- কোনো প্রেম নয়, তা কেবল এক অস্থিরতার নেশা।
সংসার হয়তো নিখুঁত নয়, কিন্তু এই সংসারের বন্ধনই মানুষের সত্যিকারের আশ্রয়।

------------------

পরকিয়া

বাংলা গল্প